softdeft

মেহেরপুরে আমের ফলন ভালো হলেও কম দামে বিক্রয় হচ্ছে

মেহেরপুরে আমের ফলন ভালো হলেও কম দামে বিক্রয় হচ্ছে

ফোকাস মেহেরপুর ।মেহেরপুর জমিদার প্রথা চালু হবার পর থেকেই মেহেরপুরের অধিকাংশ ভূমির মালিক হল এই অঞ্চলের প্রভাবশালী কয়েকজন জমিদার। তাঁদের প্রচেষ্টায় ১৮ শতক থেকে ১৯ শতকের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত এলাকার প্রখ্যাত ও বিশালাকার আমবাগান গুলোর জন্ম হয়। ১৯ শতক পর্যন্ত মেহেরপুরে প্রায় ৬৬২ হেক্টরের বেশি জমিতে আমবাগান ছিল। অন্যমত বাগানগুলোর মধ্যে গাংগুলী বাগান (বড়বাগান)(বিলুপ্ত), নায়েব বাগান (আংশিক বিলুপ্ত) দত্ত বাগান (বিলুপ্ত), হান্দবাবুর বাগান (আংশিক বিলুপ্ত), মল্লিক বাগান (বিলুপ্ত), রতনপুর বাগান, কেদারগঞ্জ বাগান, বৈদ্যনাথতলা আমবাগন (বর্তমানে মুজিবনগর আম্রকানন, আমঝুপি নীল কুঠি বাগান ( প্রায়বিলুপ্ত), চিৎলা ও বারাদি ফার্মের বাগান, ভাটপাড়া কুঠি বাগান (প্রায়বিলুপ্ত)।
এসব বাগান সমূহে হিমসাগর, লেংড়া, গোপালভোগ, খিরসাপাতি, খিরসাভোগ, জামাইভোগ, ফজলি, কাচামিঠা, কুমড়াজালি, তবলা, খেজুর ছড়ি, পেয়ারাফুলি, নারকেল পাখি, গুলগুলি, আষাঢ়ে, আশ্বিনা, বারোমাসি, মোহনভোগ, বোম্বাই, তিলি বোম্বাই, ভুতো, বিশ্বনাথ, সিন্দুরে, বেগমপছন্দ, শাহীভোগ, রাণী, বেকু, মালসা, কলাপাহাড়ি সহ অংসখ্য নাম, রঙ, স্বাদ ও গন্ধের আমচাষ হতো। আধুনিক নাগরিক সুবিধার কারণে আজ অধিকাংশ বাগান ও জাত বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অন্যদিকে এ অঞ্চলের আমের স্বাদ ও গুণগত মান ভালো হওয়াতে বর্তমানে হিমসাগর, লেংড়া, বোম্বাই, বিশ্বনাথ ও ফজলি আমের চাষ ব্যাপাকহারে বেড়েছে।
মেহেরপুর জেলার আমের সুখ্যাতি ও কদর রয়েছে দেশ জুড়ে। জেলায় উৎপাদিত আমের মধ্যে বোম্বাই, হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ ও আ¤্রপালির চাহিদা সবচেয়ে বেশি । মধু মাসের মধু ফল আম লিচু। মেহেরপুরে শুরু হয়েছে আম সংগ্রহ। বাগানে বাগানে আম ভাঙার ধুম। এখানকার আম সুসাধু হওয়ায় জেলার গন্ডি পেরিয়ে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। ঝড়-বৃষ্টি না হওয়ায় আমের ফলন ভালোই হয়েছে। ভাল দাম পেলে লাভবান হবে কৃষকেরা। কৃষি বিভাগ বলছে এ মৌসুমে প্রায় ৯৮ ভাগ গাছেই মুকুল আসার করনে আমের ফলন ভালো হয়েছে। জেলার ৩ উপজেলায় ছোট বড় গাছ মিলে প্রায় ২ হাজার ৩শ ৫০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে। যা থেকে ৫০হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। নিরাপদ আম বাজারজাত করণে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন বাগান ঘুরে আমচাষি, বাগান মালিক ও সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা যায়, মেহেরপুরের হিমসাগর আম দেশের সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু হওয়ায় ইউরোপ মহাদেশে ক্রমেই এর চাহিদা বেড়ে চলেছে কিন্তু করোনার কারনে দেশের বাহিরে আম রপ্তানি করতে পারে নাই কৃষি বিভাগ। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলেও মেহেরপুরের হিমসাগর আমের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। ফলে হিমসাগর আমের মাধ্যমে মেহেরপুর আমের জন্য প্রসিদ্ধ এলাকা হিসেবে চিহিৃত হচ্ছে। তবে এটিকে ধরে রাখতে হলে সঠিক সময় আম বাজারজাত করতে হবে বলে জানান আম চাষিরা
গেল কয়েক বছর জেলার হিমসাগর আম দেশ ছাড়িয়ে ইউরোপের বাজারে রফতানি হয়েছে। তবে কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়া এবং করোনাভাইরাসের কারণে এবারেও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরা।
বাগান থেকে আম পাড়ায় ব্যস্ত ছিলেন মেহেরপুর জেলার পিরোজপুর গ্রামের আমচাষি মুরাদ হোসেন। তিনি বলেন, আম সংগ্রহ শুরু হয়েছে। ১৮ মে থেকে হিমসাগর আম বাগান থেকে সংগ্রহ করা শুরু করেছি। উপযুক্ত দামে বাজারজাত না করতে পারলে অনেক ক্ষতি হবে।
আলতাফ হোসেন একটি বাগান কিনেছেন তিন বছরের জন্য। সেখানে ২৯০টি বড় বড় আমের গাছ রয়েছে। সবগাছেই আম এসেছে।তিনি এ বছর ১০টি বাগান কিনেছেন। সেসব বাগানে বোম্বাই, হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ ও আম্রপালিসহ বিভিন্নজাতের আম রয়েছে। প্রতি বছর তিনি চট্টগ্রাম, দিলাজপুর, বরিশাল ও ঢাকায় আম বিক্রি করে থাকেন। এ বছর তিনি সারাদেশে আম বিক্রি করবেন বলে আরও বেশি আমের বাগান কিনেছেন।
সদর উপজেলার আমঝুপি, মেহেরপুর, বামনপাড়া, আমদাহ, উজলপুর, বন্দর,আশরাফপুর, পিরোজপুর, কোলা, রায়পুর এবং মুজিবনগরের মোনাখালি, দারিয়াপুর, শিবপুর, আনন্দবাস, বাগোয়ান, সোনাপুর, মহাজনপুর এবং গাংনীর গাড়াডোব, ধানখোলা, বামুন্দী, কাজিপুর, নওদাপাড়া কাথুলীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বাগান ঘুরে দেখা যায়, কেউবা গাছ থেকে আম ভাঙছে, কেউবা সেই আমের কস শুকানোর জন্য সারিবদ্ধ করে রাখছে। আর কেউবা খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে ক্যারেট ভর্তি করায় ব্যস্ত।
কথা হয় বাগান মালিক হাসানুজ্জামান হিলোনের সাথে তিনি জানান, এখন আম ভাঙার সময় এসেছে। তার বাগানে ৪০ জন্য শ্রমিক সারাদিন ধরে কাজ করে থাকে। এখন আম প্যাকেট করে এসব আম দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। তবে পরিবহনের কারণে আম জেলার বাহিরে পাঠানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমের ফলন ভালো হয়েছে কিন্তু দাম ভালো পাচ্ছি না। হাজার থেকে ১৪শত টাকা দরে প্রতিমন আম বিক্রয় করতে হচ্ছে।
আমপাড়া শ্রমিক নাজমুল হাসান বলেন, প্রতিবছর আমরা জেলা বিভিন্ন স্থানে আম পেড়ে থাকি । প্রতি সিজিনে আমরা ২০ থেকে ৩০টি বাগানের ২৫ হাজারের বেশী গাছের আম পেড়ে থাকি। দেশে করোনা ভাইরাসের কারণে আম বাহিরে নিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। আম বাহিরে না যেতে পারলে আমরা তো মজুরী ভালো পাব না। তারপরও এই গরমে আম গাছে উঠে আম পাড়তে খুব কষ্ট হচ্ছে।

দুরপাল্লা পরিবহনের ড্রাইভার এখন সে আমপাড়া শ্রমিক মোমিনুল ইসলাম বলেন, দির্ঘদিন ধরে পরিবহনসহ যান চালাচল বন্ধ হয়ে আছে। তাই আমরা তো দিনে আনি দিনে খায়। কাজ না করলে খাব কি? বাধ্য হয়ে আমপাড়ার কাজে এসেছি। ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি। এবার সরকারের দেওয়া ১৫ কেজি চাল ও ২৫ টাকা পেয়েছি। সেটাতে তো আর বছর চলবে না। তাই একাজে আসছি।
বাগান থেকে পাকা এবং বিশুদ্ধ আম কিনতে এসেছিলেন আকতার হোসেন। তিনি জানান, মেহেরপুরের আমের স্বাদই আলাদা। এই সুসাদু আম কিনতে আমি বাগানেই ছুটে এসেছি। বাগান থেকেই পাকা আম পেড়ে খাওয়ার পাশাপাশি পরিবার পরিজনের জন্য কিছ আম কিনলাম বলেও জানান তিনি।
বগুড়া থেকে আসা আম ব্যবসায়ী এরশাদ আলী বলেন, গত কয়েক বছর ধরে আমি মেহেরপুরের আম-লিচু বাগান কিনেছি। এ জেলার লিচু এবং আম দুটিই সুস্বাদু। আমি বেশির ভাগ আম কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গার্মেন্ট মালিকদের দিয়ে থাকি এবং ভালো দাম পাই। মেহেরপুরের হিমসাগর আম ধুনলে আগের বিক্রয় হয়ে যায়। যার করনে আমাদের টেনশন করা লাগে না।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালকস্বপন কুমার খাঁ জানান, এ মৌসুমে প্রায় ৯৮ ভাগ গাছেই মুকুল আসেছিল। জেলায় প্রায় ২ হাজার ৩শ ৫০ হেক্টর জমিতে আমের বাগান রয়েছে।
আম উৎপাদনের সম্ভাবনা ভালো রয়েছে। মেহেরপুর জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সব জাতের আমেরই চাষ হচ্ছে। এবছর আমের দাম ভালো । আমরা আশা করছি আমচাষীরা ও বাগান মালিককেরা আমে লাভবান হবে। ভোক্তাদের কাছ নিরাপদ আম পৌঁছে দেবার লক্ষে কৃষি বিভাগ কাজ করছে বলে জানালেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

Total Page Visits: 1162 - Today Page Visits: 1